বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন
মুফতি মাহবুব হাসান:
আজ বিশ্ব মানবতা দিবস। মানবিক কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবক, চিকিৎসক, ত্রাণকর্মী, শান্তিরক্ষী বা অন্যান্য কর্মীরা বিশ্বের নানা প্রান্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শনই এ দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য। মানবতা দিবস মানুষকে মনে করিয়ে দেয় ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা জাতীয়তা নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, শরণার্থী, মহামারীসহ বিভিন্ন সংকটকালে কোটি কোটি মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়। এ দিবস তাদের দুর্দশার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ যেন মানবিক বিপর্যয়ে আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে পারে, সেটিই দিবসটির অন্যতম মূল লক্ষ্য।
মানবতা মানুষের ভেতরে নিহিত একটি সহজাত প্রবণতা, যা মানুষকে মানুষ হিসেবে আলাদা মর্যাদা দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যত সভ্যতা বিকশিত হয়েছে, যত ধর্ম ও দর্শন মানবতার কল্যাণে কথা বলেছে, ইসলাম তার মধ্যে অনন্য। কারণ ইসলাম কেবল ইবাদত-বন্দেগির ধর্ম নয়, বরং এটি মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণের ধর্ম। আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো, সে নামাজ-রোজা পালন করার পাশাপাশি মানবতার কল্যাণে কতটা অবদান রেখেছে। কোরআন ও হাদিসে অসংখ্য জায়গায় এ সত্য তুলে ধরা হয়েছে।
মানুষ সামাজিক জীব। একে অপরের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীতে জীবন যাপন করে। কেউ একা নিজের জন্য সবকিছু জোগাড় করতে পারে না। তাই মানুষের জীবন পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। ইসলামের শিক্ষা হলো, মানুষের জন্য মানুষই আশ্রয়, আর সৎকার্য ও সেবাই মানুষের প্রকৃত মূল্য। আল্লাহর কাছে ধন-সম্পদ, ক্ষমতা বা বংশ নয়, বরং মানুষের আন্তরিকতা, মানবপ্রেম এবং সেবাই আসল মর্যাদা অর্জনের মাধ্যম।
কোরআনের সুরা বাকারার ১৭৭ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘বড় সৎকাজ কেবল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ করে নামাজ পড়াই নয়, বরং আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির এবং ক্রীতদাসদের মুক্তির জন্য ব্যয় করা, নামাজ-জাকাত আদায় করা এবং কঠিন সময়ে ধৈর্যধারণ করাই প্রকৃত সৎকর্ম।’ এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, সামাজিক দায়িত্ব এবং মানবকল্যাণ ইসলামের অপরিহার্য অংশ।
মানবসেবাকে ইসলাম ফরজ আমলের মর্যাদা দিয়েছে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যেমন ফরজ, তেমনি মানবসেবাও ফরজ। এর অর্থ, মানবকল্যাণের কাজ করলে তা কেবল সামাজিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য হবে না, বরং আল্লাহর আদেশ পালনের শামিল হবে। যে ব্যক্তি সম্পদশালী, সে সম্পদ দিয়ে মানবসেবা করবে। যে ব্যক্তি জ্ঞানবান, সে জ্ঞান দিয়ে মানুষকে উপকার করবে।
যে ব্যক্তি শক্তিমান, সে তার শক্তি দিয়ে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসবে। প্রত্যেককে তার সাধ্য অনুযায়ী মানবকল্যাণে অংশ নিতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা ভালোবাসে, তা তার মুসলিম ভাইয়ের জন্যও ভালোবাসে। এ হাদিস মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা ও সহানুভূতির অনন্য উদাহরণ। আমরা নিজের জন্য সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নতি কামনা করি। ইসলামের দাবি হলো, আমরা অন্যের জন্যও একই কামনা করব।
মানবপ্রেম জান্নাতিদের গুণ। কোরআনের সুরা দাহরে বলা হয়েছে, ‘জান্নাতিরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার করায়। তারা বিনিময়ে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করে না।’ এই দৃষ্টান্তে আল্লাহ মানুষের প্রকৃত মানবপ্রেমিক রূপটি তুলে ধরেছেন। মানবসেবা নিছক মানবিক দায় নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করাই আসল উদ্দেশ্য।
আজকের পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ নিজের উন্নতি, সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হলো, অন্যের জন্যও সেই কামনা রাখতে হবে। নিজের জন্য যেমন ক্ষুধা-তৃষ্ণা চাই না, অন্যের জন্যও তা চাইতে পারব না। নিজের জন্য যেমন নিরাপত্তা চাই, অন্যের জন্যও চাইতে হবে। নিজের কল্যাণ যেমন চাই, অন্যের জন্যও চাইতে হবে। সমাজে সবাইকে নিজের মতো করে ভাবা ও দেখা, এটাই প্রকৃত মানবপ্রেম।
রাসুল (সা.) মানবপ্রেম ও দয়ার গুরুত্ব বুঝাতে বলেছেন, ‘জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো, আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ অর্থাৎ মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমেই আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়। আল্লাহর দয়ার ছায়া লাভ করা ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়।
মানবসেবার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ শুধু আমলের জোরে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশের জন্য আল্লাহর রহমত অপরিহার্য। আর আল্লাহর রহমত লাভের সহজ পথ হলো, মানবকল্যাণে অংশ নেওয়া। নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সেই, যে মানুষের বেশি উপকার করে। তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো, কোনো মুসলমানকে আনন্দ দেওয়া, তার দুঃখ দূর করা, ঋণমুক্ত করা বা ক্ষুধা নিবারণ করা।
মানবপ্রেম শুধু দুনিয়ায় কল্যাণ বয়ে আনে না, বরং বিপদাপদ থেকেও রক্ষা করে। নবীজি বলেছেন, মানবকল্যাণমুখী কাজ বিপদাপদ ও অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। গোপন দান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় আয়ু বৃদ্ধি পায়। এসব হাদিসে মানবসেবার বহুমাত্রিক কল্যাণের চিত্র পাওয়া যায়।
আজ বিশ্ব মানবতা দিবসে আমাদের উচিত ইসলামের এ শিক্ষা স্মরণ করা। আধুনিক পৃথিবী নানা সংকটে জর্জরিত। যেমন যুদ্ধ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, শরণার্থী সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নৈতিক অবক্ষয়। এসব সমস্যার সমাধান কেবল আইন বা প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব নয়, বরং মানুষের ভেতর মানবপ্রেম জাগ্রত করাই হলো আসল পথ। মানবপ্রেম জাগ্রত হলে মানুষ একে অপরকে ভালোবাসবে, কষ্টে-দুঃখে পাশে দাঁড়াবে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একত্র হবে।
পশ্চিমা বিশ্বে মানবতার ধারণা মূলত মানবিক আইন, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় কল্যাণনীতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা মানবতাকে আল্লাহর হুকুম হিসেবে উপস্থাপন করে। এ পার্থক্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য জায়গায় মানবসেবা নৈতিক দায়িত্ব হতে পারে, কিন্তু ইসলামে এটি ইমানের অঙ্গ। মানবসেবা করলে তা কেবল দয়া নয়, বরং ইবাদত।
মানবপ্রেম ও মানবসেবার বাস্তব উদাহরণ রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। হজরত আবু বকর (রা.) ছিলেন মুক্তিকামী দাসদের মুক্তির জন্য অগ্রণী। হজরত ওমর (রা.) রাতের অন্ধকারে গরিবদের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিতেন। হজরত ওসমান (রা.) দুঃখী মানুষের সেবায় তার ধন-সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। হজরত আলি (রা.) এতিম ও মিসকিনদের জন্য তার সম্পদ দান করতেন। ইসলামের ইতিহাসে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে।
আজকের বিশ্ব মানবতা দিবসে আমাদের এই শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, মানবসেবা কোনো বিকল্প কাজ নয়, বরং অপরিহার্য দায়িত্ব। প্রতিটি মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী মানবকল্যাণে অংশ নিলে পৃথিবী শান্তি ও সমৃদ্ধির আবাস হয়ে উঠবে।
মানবতার শিক্ষা কেবল বিশেষ দিবসে সীমাবদ্ধ থাকার মতো নয়। প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের মানবপ্রেম চর্চা করতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে সচেষ্ট হতে হবে। আমরা যদি ইসলামি ঐতিহ্যের এই মানবিক চেতনাকে জীবনের অংশ করি, তবে মানবতা দিবস সত্যিকার অর্থে সফল হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানবতা শুধু মানবিকতার সেøাগান নয়, বরং ইমানের অপরিহার্য অঙ্গ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, জান্নাতের সৌভাগ্য অর্জন এবং পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মানবপ্রেমই হলো শ্রেষ্ঠ পথ। তাই আসুন, বিশ্বমানবতা দিবসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আমরা সবাই আল্লাহর জন্য মানুষের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করব।
ভয়েস/আআ